পৃথিবীতে অনেক মানুষ অনেক ভাবে গৌরবের অধিকারী হয়ে থাকেন। কেউ রাজনীতিতে, কেউ ধমনীতে, কেউবা সমাজনীতে, কেউ আবার শিক্ষানীতিতে খ্যাতি অজন করে চিরঞ্জীব হয়ে থাকেন। তেমনি ভাবে আমাদের মাঝে চিরসরনীয় ও বরনীয় হয়ে আছেন সন্তোষ ছয় আনীর জমিদার শ্রীমতি জাহ্নবী চৌধূরাণী।
১৮৭০ সালে টাঙ্গাইলের সন্তোষ ছয়আনীর নারী জমিদার বিদ্যোৎসাহী শ্রীমতি জাহ্নবী চৌধুরাণী তার এলাকার জনগনের মধ্যে শিক্ষার আলো পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে জমিদারীর অর্থে নিজ বসতবাড়ীর আঙ্গিনায় প্রায় ৪.৫০ একর জায়গায় প্রতিষ্ঠা করেন সন্তোষ জাহ্নবী উচ্চ বিদ্যালয়।
এটি তৎকালীন বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার দ্বিতীয় এবং বর্তমান টাঙ্গাইল জেলার সর্বপ্রাচীন উচ্চ বিদ্যালয়। তিনি পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পরামর্শ ও পরিকল্পনা মোতাবেক তিনশত ফুট দীর্ঘ চুন সুরকীর চব্বিশ ইঞ্চি দেওয়ালে বিশ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট সুদৃঢ় ও সুদৃশ্য মনোরম পাকা অট্রালিকা নির্মাণ করেন।
বিদ্যালয়ে অবস্থান কালীন সময়ে শিক্ষার্থীদের স্বাচ্ছন্দের প্রতি লক্ষ্য রেখে সময় নিরুপনের সুবিদার্থে বিদ্যালয় সম্মুখে সূর্য ঘড়ি (Sun dial) ১৮৭৩ সালে বিখ্যাত পুরুষ পি.সি.সেন এম.এ এর সহযোগিতায় নির্মিত হয়। শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যকর পরিবেশের জন্য বিশাল দীঘি এবং এর পারিপার্শ্বিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য জানালা বিহীন এবং দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ বরাবর সমান্তরাল ভাবে ১০১ টি বিশালাকৃতি দরজা বিশিষ্ট প্রাসাদোপম ইমারত তৈরী করেন। জাহ্নবী চৌধুরাণীর চিন্তা ভাবনা মোতাবেক শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের পরিধি বিস্তারের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন পাঠাগার ও বিজ্ঞানাগার। যেখানে জ্ঞান বিজ্ঞানের বহু দুষ্প্রাপ্য পুস্তকাদি এবং বৈজ্ঞানিক সরঞ্জামাদি রয়েছে, যার মধ্যে ৩৬ খন্ডের বিশ্বকোষ "Encyclopaedia Britenica" উল্লেখযোগ্য।
সন্তোষ জাহ্নবী উচ্চ বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, আসাম ও ব্রহ্মদেশ এই পাঁচটি প্রদেশের মধ্যে ১৮৯৬ সালে দি. দি মহিম চন্দ্র ঘোষ, ১৯২৬ সালে দেবেন্দ্র নাথ ঘোষ তৎকালীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রবেশিকা (এন্ট্রার্স) পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলেন।
মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড ঢাকা এর অধীনে ১৯৬৫ সালে নিতাই দাস পাল এবং ১৯৬৯ সালে আশিষ কুমার পাল এস.এস.সি পরীক্ষায় মানবিক শাখায় প্রথম বিভাগে প্রথম হয়ে বিদ্যালয়ের গৌরব অক্ষুন্ন রাখেন। দেশ স্বাধীন হবার পরও অসংখ্য ছাত্র ঢাকা বোর্ডের মেধাতালিকায় স্থান অর্জন করে আসছেন। এছাড়াও পাক-ভারত উপমহাদেশে অনেক প্রতিভাবান ব্যক্তি রয়েছেন যারা এই বিদ্যাপীঠের ছাত্র হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং এই ঐতিহ্যবাহী সন্তোষ জাহ্নবী উচ্চ বিদ্যালয়ের সুনাম উপমহাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়েছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন সুবিখ্যাত বহুল পরিচিত গ্রন্থ "ঠাকুরমার ঝুলি” লেখক দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার।
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই সন্তোষ জাহ্নবী উচ্চ বিদ্যালয়টি ঐতিহ্যবাহী হওয়ায় অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন।
সত্তর এর দশকে সন্তোষ জাহ্নবী উচ্চ বিদ্যালয়ের স্কাউট দল স্থানীয় ও বিভাগীয় পর্যায়ে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেন। ১৯৯১ সালের ২৫ শে জানুয়ারী বাংলাদেশ বেতারের "নির্ঝর" অনুষ্ঠানে বিদ্যালয়ের ছাত্র/ছাত্রী অংশগ্রহণ করে এবং উক্ত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিদ্যালয়ের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও প্রতিষ্ঠাকালীন অবস্থা তুলে ধরে মাননীয় সরকারে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং রাষ্ট্রীয় পুরস্কার প্রাপ্ত হন।
সন্তোষ জাহ্নবী উচ্চ বিদ্যালয়টি বর্তমান টাঙ্গাইল পৌরসভার অন্তর্গত হলেও প্রতিষ্ঠাকালে এটি তৎকালীন জমিদার বাড়ীর আঙ্গিনায় স্থাপিত হওয়ায় শিক্ষা ক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে চলেছে। শহরের কোলাহল মুক্ত কিছুটা গ্রাম্য পরিবেশে এর অবস্থান হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটি স্থানীয় জনসাধারণ ও দূর-দূরান্তের শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিদের জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে চলেছে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, সন্তোষ ছয়আনীর জমিদার শ্রীমতি জাহ্নবী চৌধুরাণীর নয় বছর বয়সে বিবাহ হয়ে ছিলো এবং তের বছর বয়সে বিধবা হয়ে ছিলেন।
স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি জমিদারের দায়িত্ব গ্রহন করেন। জমিদারের দায়িত্ব পালন করার সময় তিনি দরিদ্র প্রজাদের দুঃখ দূর্দশার কথা বিবেচনা করে দরিদ্র প্রজার সন্তানদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করার লক্ষ্যে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন দেখেন। যার ফলশ্রুতিতে অত্র বিদ্যালয়টি তাঁরই নামে ১৮৭০ সালে স্কুল হিসেবে একটি ছোনের ঘর নির্মাণ করে স্কুলে যাত্রা শুরু করেন। পরবর্তীতে ১৮৮৩ সালে তৎকালীন জমিদারের নিজস্ব অর্থায়নে ৪০,০০০/- হাজার টাকা ব্যয়ে একটি সুন্দর প্রাসাদোপম অট্টালিকা নির্মাণ করেন।
তিনি নির্মাণ সামগ্রী ক্রয়ের জন্য নৌকাযোগে ভারতের কলকাতাতে গিয়েছিলেন। ভারতের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য থেকে নিজে পছন্দ করে মানসম্মত উপকরণ ক্রয় করে আনেন।
যার নির্মান কাজ সমাপ্ত হয় ১৮৮৮ সালে। স্কুলে যাত্রা কালীন সময়ে জমিদারের নিজস্ব অর্থ থেকে পাঠাগার ও আসবাবপত্রের জন্য এককালীন অনুদান ১,০০০/- টাকা, দরিদ্র ছাত্র/ছাত্রীদের জন্য মাসিক বৃত্তি ২২০/- টাকা এবং ৩২ জন শিক্ষক কর্মচারীর জন্য মাসিক সম্মানি ভাতা বাবদ অনুদান ১৫০/- জমিদারের কোষাগার থেকে নির্বাহ করতেন। সেকালে মত আজও কাছের ও দূরের শিক্ষিত জন সাধারণের দর্শনীয় বিদ্যাপীঠ। বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকে অধ্যবধি যারা সার্বিকভাবে সহযোগিতা করেছেন তাদের সবাইকে জানাচ্ছি আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতগতা। বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রী যারা জীবিত আছেন তাদের দীর্ঘায়ু কামনা করছি এবং যারা পরলোক গমন করেছেন তাদের আত্নার মাগফিরাত কামনা করছি।
শিক্ষার মূল লক্ষ্য যেন হয় মানুষকে বৃহৎ বিশ্বের জন্য প্রস্তুত করে উর্ধ্বালোকে নিয়ে যাওয়া এবং উত্তম চরিত্র গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখা। শিক্ষার উদ্দেশ্য কেবল ডিগ্রি অর্জন নয় উদ্দেশ্য হতে হবে দায়িত্বশীল মানুষ হিসেবে গড়ে উঠা এবং পরিবর্তনশীল বিশ্বের সাথে অভিযোজিত হয়ে চলতে পারার মত অর্জন করা। শিক্ষিত আলোকিত ও সৃজনশীল মানুষ গঠন করাই আমার মূল লক্ষ্য।
পরিশেষে আমি আশা করি গৌরবোজ্জল এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তার অতীত গৌরবের ইতিহাসকে সমুন্নত রেখে সফলতার সাথে এগিয়ে নিয়ে যাব। ইনশাআল্লাহ।
মো. মিয়াচান
প্রধান শিক্ষক
সন্তোষ জাহ্নবী উচ্চ বিদ্যালয়